মা'দেরকে যেভাবে হর্ষবাদ দেয়া হয়, শব্দে, ধ্বনিতে বাণীতে, কথায়, গল্পে কিংবা কল্পে; তুলনামূলক তার কাছাকাছিও বাবাদের জয়জয়কার শোনা যায়না। সম্ভবত এক "বাবা-দিবসে" ছাড়া আর খুব একটা চোখে পড়েনা। তা সে যে বড় একটা আড়ম্বরপূর্ণ তাও না।
ভেবে দেখুনতো আপনি কখনো "বাবার-দোয়া-হোটেল" নাম শুনেছেন? অথচ থাকা, খাওয়া, ওঠা, শোয়া সব কিন্তু বাপের ব্যক্তিগত হোটেলেই হয়!
কিন্তু সবসময় নাম দেখবেন "মায়ের দোয়া হোটেল" বা "মায়ের-দান"। এমনকি গাড়িতে, বাড়িতে, রিক্সার পিছনে, ট্রাকের পাঁজরে সবখানে "মায়ের দোয়া"
কোথাও যদিবা বাবা'র কথা আসে, সেটাও আসে "মা" এর পিছনে লাইনে দাঁড়িয়ে। "মা-বাবা'র দোয়া"!
আমার কাছে ব্যাপারটা খুব পীড়াদায়ক ঠেকে। আর তার উপরতো আমাদের মধ্যবিত্ত বাবারা ঠিক বাবা হয়ে ওঠার আগেই দাদা/নানা হয়ে যায়!
আমি যখন বাড়ি ছেড়ে প্রথম বেরিয়েছিলাম, এক পাহাড় অভিমান আর এক সমুদ্র আক্ষেপ, চেপে রাখা ক্ষোভ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। যত আমি শেকল ভাঙতে শিখেছি, যতবার একা একা পড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি ততবার আমি ক্ষমাশীলতার কয়েকধাপ অতিক্রম করেছি। আমি মা'কে ক্ষমা করেছি। আরো ক্ষমা করেছি আমাকে আঁচড়ে আহত করা প্রতিটি আত্মাকে।
কিন্তু বাবার হিসেব নিকেশ করতে যেয়ে দেখি তার হিসাবের খাতা শূন্য। কোনো অপরাধ আমার হিসাবের খাতায় নেই।
আশ্চর্য! তা কী করে হয়! বাবার প্রতিইতো আমার সকল ব্যর্থ অনুক্ত অভিযোগ।
আমার জন্মদিন মা মনে করিয়ে না দিলে বাবা-র কখনো মনে থাকেনা, আমার রোল নাম্বার পর্যন্ত জানতোনা, আমার মাস্টারের বেতন দিতে দেরি করেছে বলে কত অপমানিত হয়েছি, একটা নতুন ব্যাগের আশায় উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ফেলা, কতদিন রাগে, অপমানে কেঁদে বলেছি "আব্বু তুমি এত গরীব কেনো! যাবোনা আমি আর স্কুলে"
এসব ছোট বড়সহ আরো কত অপরাধে অপরাধী হবার কথা তাঁর। অথচ হিসাবের খাতায় তার কোনো অপরাধই নেই!
আমার বাবা আমার "হিরো" না। বাবাও আর দশজন আটপৌরে মধ্যবিত্ত বাবাদের মতই অপ্রতিভ, জবুথবু, শ্রান্ত এক মানুষ। সংসারের এক আমোঘ ঘানি টেনে চলেছে যুগযুগ ধরে কারো কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়াই।
ভেবে দেখলাম আমার বাবা কেবলই এক বোকা-বাবা।
যার কাছে জীবনটা সকালে উঠো-রোজগারের পথে হাঁটো-ঘরে ফিরে খাও দাও-ঘুম চক্রেই থেমে যায়।
আমার ছোট বেলার বাবা নিয়ে যত গল্প মা'র কাছে শুনি তার মাঝে বাবাকে নিয়ে সবচেয়ে প্রিয় গল্প হলুদ জামার গল্প।
সেই জামা পুরো বাজার ঘুরে একমাত্র একটা জামাই পছন্দ হয় বাবার। সেই জামা কিনতে আমার জামার বাজেট ফুরিয়ে অন্যান্য সবার ভাগের টাকা যোগ করেও নাকি সেই জামার দাম হচ্ছিলনা। তারপরও বাবা নাকি মা'কে দোকানে বসিয়ে রেখে বাড়িতে গিয়ে টাকা এনে সেই জামা কিনে তবেই বাড়ি ফিরেছে।
মানুষ হিসাবে বাবা একেবারেই বৈশিষ্ট্যহীন সাদামাটা প্রান্তিক। ত্রুটি বিচ্যুতি সব নিয়ে। কিন্তু বাবা হিসাবে আমার বাবা অনন্য।
বাবা আমার কাছে কোনো "হিরো" নয় বরং একজন মধ্যবিত্ত গরীব-জাদুকর।
যে জাদুকরের কোনো চাকচিক্য নেই, আহামরি কোনো জাদুও দেখাতে পারেনা কিন্তু তবুও...
কিছু না করেও সবটা সম্ভব করে দেয়, কিছু না বলেও সবটা বুঝিয়ে দেয়, কিছু না দিয়েও সবটা পাইয়ে দেয়।
সে থাকে খুব আবছায়ার মত, আছে কী নেই ঠাহর করা যায়না। কিন্তু জাদু'র ছোঁয়ার দরকার পড়লেই, সে কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়।
আমি উপলব্ধি করি জীবনের সব রকম জঘন্য, তিক্ত, যন্ত্রণা দাঁতেদাঁত চেপে সয়ে গেছি হাল না ছেড়ে কেবল এটা জেনেই যে জিতি-হারি তাতে কিছু আসে যায়না কারণ- আমার এক জাদুকর আছে। সে কিছু ঠিকঠাক না হলেও, ঠিক করে দেবে নিমেষেই।
আবার জাদুকর আছে বলে হাল ছেড়েও দেইনি। কারণ আমি সেই ছোট্ট বয়সেই বুঝেছি তার জাদু'র উৎসই আমি। আমি যত শক্তি অর্জন করবো সে ততবড় জাদুকর হবে।
আর এই প্রজন্মের আমাদের সাথে মানুষ হিসাবে বাবাদের দূরত্ব বিস্তর হলেও বাবা হিসাবে অতটা নয়। আমার সাথেও আছে চিন্তা ভাবনার দূরত্ব, চাওয়া পাওয়ার দূরত্ব। সে দূরত্ব আমাদের একে অপরের কাছ থেকে ঠেলে নিয়ে বহু ক্রোশ।
Reveal spoiler
বাবা যখন সিনেমা দেখছিল আমিও কাজ বাদ দিয়ে সিনেমা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বাবাটা যদি আরেকটু সময় দিত আমাকে, আরেকটু অল্প আটপৌরে আর অপ্রতিভ হতো!
কলেজে থাকাকালীনও বাবার সাথে রাজনীতি নিয়ে তুমুল বাক বিতন্ডা হতো।
মা এসে থামিয়ে দিয়ে বলতো-
"হয়েছে থামো! তোমাদের দুজনের কাউকেই সরকার এসে চাল-ডাল দিয়ে যাবেনা। খামোখা বাড়ি মাথায় না তুলে যারযার কাজে যাও!"
মধ্যবিত্ত বাবারা বাবা হয়ে ওঠার সুযোগ কদাপি পায়না। তারা বিয়ে কেনো করলো, সন্তান কেনো চায় সেটা বুঝে ওঠার আগেই পরিবার আর সমাজের কল্যাণে সন্তান আনে। তারপর সে সন্তানের অর্ধেক দাস আর অর্ধেক প্রতিপালক হয়ে, সাম্যবাদ আর পুঁজিবাদের কোপানলের মাঝে সার্ভাইভাল গেম খেলে কূল পেতে না পেতেই উপলব্ধি করে, এখন সন্তানই তাদের প্রতিপালক।
সবকিছুর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা, সে সন্তান হারিয়ে যায় সব অনুযোগ আর অবহেলার চৌকাঠে।
আর এভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না পেয়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলে যায় আমাদের মধ্যবিত্ত বাবারা।
আমি খুশি যে আমার জাদুকরকে সে ফাঁসিকাঠের চৌকাঠ মাড়াতে হয়নি। আমি খুশি আরো অনেক জাদুকরকেই হয়নি। আর গভীর আফসোস যেসব জাদুকরদের প্রতি, যারা অনাবিষ্কৃত থেকে গেলো জীবনভর।
As you know, I am a dad myself...
And I must say, it is tough both as a Mom and as a Dad. Also it had been tough as a kid. But somehow it works out.
And so far I know an amazing one. And you are also spending as much time as you can with them.
They will have some amazing memories to cherish when they reach at my age.
Congratulations @fahmidamou! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 60 posts.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!
আমিও এক মধ্যবিত্ত বাবার সন্তান।
কত যে অভিযোগ আমার তার উপরে।
এখন খুবি কম কথা বলা হয় আমার মধ্যবিত্ত বাবার সাথে।
আমাদের এ প্রজন্মের সবারই বোধহয় আছে কমবেশী। ৪/৫ বছর আগেও প্রচন্ড তীব্র ছিল সেসব অভিমান, অভিযোগ। মনে হতো কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবোনা। কিন্তু এখন ওসব ক্ষত শুকিয়ে গেছে, দাগ রয়ে গেছে। দাগতো আর জ্বালায় পোড়ায় না।
আপনিও পারবেন ক্ষমা করতে। কারণ আমরা যারা এগুলা নিয়ে ভাবী তারা সবাই দিনশেষে ক্ষমাশীল মানুষ।
আমিও এমোনি মনে করি।
তবে আপনার লেখাটা খুবি কাছে নিয়ে গেছিলো।
থ্যাংকিউ পার্থ। সেটাই উদ্দ্যেশ্য ছিল। অল্প সময়ের জন্য হলেও।
সিনিয়রা কেউ অন্তত পার্থ ডাকলো।
নাহয় সাবাই ভাই, পার্থ ভাই ডাকে কমিউনিটিতে😢।
থ্যাংকিউ আপু।