শ্রীনগরের পথে পথে | কাশ্মীর ট্যুর | পর্ব ০১

in BDCommunity4 years ago

সেই কবে থেকে শুনে আসছি, দুনিয়ার স্বর্গ হলো কাশ্মীর। কিন্তু এত জায়গা ঘুরে ফেললেও কাশ্মীর ঘোরা হলোনা! ২০১৭ এর দিকে কাশ্মীরের এক প্রান্ত লাদাখ ঘুরে আসলাম। লেহ শহর, নুব্রা ভ্যালি, প্যানগং লেক, রুক্ষ পাহাড়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মাইলকে মেইল রাস্তা স্রেফ পাগল করে দিয়েছিলো আমাকে। সুযোগ পেলে আবার যাবো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০০০ ফিট উপরের শহরটাতে।

তবে কাশ্মীর বলতে যা শুনে এসেছি, বা দেখে এসেছি বলিউড মুভিতে ছোটকাল থেকে, সেই কাশ্মীরের স্বাদ লাদাখ গিয়ে পাইনি। সেই স্বাদ পেতে যেতে হবে শ্রীনগর।

তাই অবশেষে লম্বা ইন্ডিয়া ট্যুর প্ল্যানের মধ্যে ধুম করে কাশ্মীর এড করে দিলাম। কাশ্মীরের সবুজ রূপ, আর হাজারো টিউলিপের সমারোহ দেখতে যাবেন এপ্রিল থেকে আগস্টের মাঝামাঝি সময়। এই সময় কাশ্মীর টুরিস্টে গিজগিজ করে। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিলো স্নোফল দেখার, এবং টুরিস্ট প্লেস খালি থাকলেই ভালো লাগে। আরাম করে ঘোরা যায়।

তাই নভেম্বরেই অনেক সময় নিয়ে ভারত ট্যুর দিয়ে দিলাম। এমনিতে তখন ঠাণ্ডা পরছিলো। দিল্লীতে জ্যাকেট গায়ে দিতে হয়েছিলো। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে বিমানের দরজা থেকে যেইমাত্র বাইরে পা দিলাম, মনে হলো ঠাণ্ডা বাতাস সুঁই হয়ে চামড়া ভেদ করে যাচ্ছে! ওরে বাবা, একি ঠাণ্ডা!

কাধব্যাগে গরম কাপড় যা যা ছিলো সবি গায়ে চাপালাম। চিন্তা করছি বেলা ১১টায় যদি এই অবস্থা দাঁড়ায়, তো রাতে কি হবে! যাই হোক, এত কিছু না ভেবে সুন্দরভাবে এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি কমপ্লিট করে পারকিং এর দিকে গেলাম। বলে রাখা ভালো, শ্রীনগর এয়ারপোর্টের সবাই খুবই ফ্রেন্ডলি। কাশ্মীরের অন্য দেশের টুরিস্ট আসলে একটা এম্বারকেশন ফর্ম পূরণ করতে হয়। এয়ারপোর্টের যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই এইসব ব্যাপারে হেল্প করবে।

আমাদের হোটেল উইলসনের মাধ্যমে আগে থেকে গাড়ি ঠিক করা ছিলো। আমাদের হোটেল ডাল লেক থেকে কাছে। বুকিং ডট কমে ভালো রেটিং দেখেই হোটেল বুক করেছিলাম। যাই হোক, এয়ারপোর্ট থেকে শ্রীনগর শহর দেখতে দেখতে হোটেলের দিকে যাচ্ছি। দূরত্ব প্রায় নয় কিলোমিটারের মত।

শ্রীনগর ছিমছাম শহর। রাস্তায় খুব বেশি মানুষজন নেই। ডাল লেক, লাল চকের দিকেই মানুষজন একটু বেশি দেখলাম। বেশিরভাগ মানুষ ট্র্যাডিশনাল কাশ্মীরি পিরান পরে হাঁটাহাঁটি করছে। ইয়ং ছেলেমেয়েরা অবশ্য আধুনিক ড্রেসেই আছে। আর প্রতিটা কাশ্মীরি ছেলে মেয়ে এত সুন্দর, বিশেষ করে ছেলেরা। আমি মেয়ে হলে বোধহয় প্রেমে পরে যেতাম। :P কাশ্মীর টুরে প্রতিবারই টাস্কি খেয়েছি যখন দেখেছি কাশ্মীরের পথে ঘাটে বলিউডের নায়কদের থেকে বেশি সুন্দর ছেলেপেলে নৌকা বা ট্যাক্সি চালাচ্ছে, অথবা রাস্তায় হকারি করছে।

আর আসার আগেই শুনেছিলাম সবার সতর্কবাণী! কাশ্মীর যাচ্ছিস যা, তবে সাবধানে থাকবি। আমরা আসার মাসখানেক আগেও নাকি শ্রীনগরে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছিলো। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যাবার পথে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইন্ডিয়ান আর্মি! অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সাঁজোয়া গাড়ি! দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি যুদ্ধ লেগে গেলো।

যাই হোক, হোটেলের কাছাকাছি ডাল লেক এসে সারাদিনে জার্নির ধকল ভুলে গেলাম। এত্ত সুন্দর, শান্ত আর ছিমছাম পরিবেশ! হোটেলটাও সুন্দর, আর হোটেল মালিকও দুর্দান্ত মানুষ। পুরো কাশ্মীর ট্যুরে ভালো সাহায্য করেছেন।

সেইদিন আমাদের খুব বেশি প্ল্যান ছিলোনা। শ্রীনগর শহরটা ঘুরবো, ডাল লেকে শিকারা চড়বো, আর কোথায় ভালো খাবার দাবার পাওয়া যায় ঢু মারবো।

একজন পরামর্শ দিলো খৈয়াম চক চলে যান, খৈয়াম চক খাবার দাবারের স্বর্গ। ভুল বলেনি সেই লোক। ৬০ রূপিতে ট্যাক্সি নিয়ে খৈয়াম চক চলে গেলাম। গিয়েই দেখি চারিদিক কাবাবে কাবারন্ন!!! এত ধরনের কাবাব, দেখেই জিভে জল এসে গেল। যদিও সব কাবাবের ছবি তুলা হয়নি, কারণ খেতে খেতে কি আর এত কিছু খেয়াল থাকে?

এই এক জায়গায় এসে গলা অবধি খেলাম। কাবাব থেকে শুরু করে কোন কিছুই বাদ দেইনি। চোখের সামনে যা পেয়েছি, খেয়েছি!

খৈয়াম চকে কি নেই! এই ঠাণ্ডায় আইসক্রিম সেল করছে, কেউ এক সাইডে ভ্যানে মোমো বানাচ্ছে, বাংলা খাবারের কিছু হোটেল ও আছে। তবে আইসক্রিম এর কাছাকাছিও গেলাম না। তাছাড়া খোলা ট্যাক্সিতে চড়ে যে পরিমাণ ঠাণ্ডা খেয়েছি, তাতে লোকাল আইসক্রিম খাবার স্বাদ উবে গেছে। তবে শেষ দিন বিখ্যাত কুলফি খেয়েছিলাম।

খৈয়াম চক থেকে ব্যাক করলাম ডাল লেকে। তাপমাত্রা সম্ভবত সাত কিংবা আট। রাতে নাকি সেটা শূন্যের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকে! হোটেলের ছেলেটা জানালো দুএকদিনের মধ্যে নাকি স্নোফল হতে পারে। আর যদি হয় তা হবে গত বিশ বছরের রেকর্ড! কারণ গত বিশ বছরে নাকি শ্রীনগর শহরে নভেম্বরে কখনো স্নোফল হয়নি!

যাই হোক, ডাল লেকে গিয়ে ৫০০ রুপি দিয়ে ২ ঘন্টার জন্য শিকারা ঠিক করলাম। শিকারা হলো কাশ্মীরি ট্র্যাডিশনাল নৌকা। পুরো রাজকীয় নৌকার মতো, আরাম করে হেলান দিয়ে বসার জন্য গদিও আছে। এই ধরনের নৌকা ইতালির ভেনিসেও দেখা যায়।

শিকারা চলা শুরু করার সাথে সাথে ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে গেলাম। অবশ্য সেই কথা চিন্তা করে শিকারার মাঝি নৌকায় পাতলা কম্বল ও রেখেছে। ৫০০ রূপিতে পুরো ভিআইপি সেবা!

ডাল লেকের দুপাশে সারি সারি হাউজবোট। এইসব হাউজবোটগুলো শতবর্ষ পুরনো, কিন্তু এখনো জাকজমক অবস্থায় আছে। এইসব হাউজবোটে অল্প কিছু রুপি খরচ করে রাত থাকা যায়। আমাদের পাঁচদিনের কাশ্মীর ট্যুরে একরাত হাউজবোটে থেকেছিলাম। হাউজবোটের ভেতরে পুরো আগের আমলের রাজকীয় সাজসজ্জা! সেই গল্প আরেকদিন হবে।

যাই হোক আস্তে আস্তে ডাল লেকের গভীরে ঢুকে যেতে লাগলাম। আস্তে আস্তে লেক বড় হচ্ছে, আর সৌন্দর্য বাড়ছে। আর যত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডাও বেড়ে চলছে!

ডাল লেকের সবচাইতে ভালো লেগেছে ফ্লোটিং মার্কেটটা। হরেকরকম জিনিসের দোকান আছে এইখানে। তবে দাম এবং কোয়ালিটি চিন্তা করে এইখান থেকে কিছু কেনা হয়নি। শেষ দিন লাল চক থেকে শপিং করেছিলাম।

ডাল লেক ভ্রমণ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। কাশ্মীরে এমনিতেও রাত ৮ টার মধ্যে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। শুধু ডাল লেকের আশে পাশে টুরিস্ট হাব হওয়াতে রাত ১০ টা পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট সহ অল্প কিছু সুভেনির শপ খোলা থাকে।

তবে এই সময় টুরিস্ট কম থাকাতে রাত ৯ টায় বের হয়েও আমরা একটা পাঞ্জাবি ধাবা ছাড়া আর কিছু খোলা পাইনি। অবশ্য এই ঠাণ্ডায় আমাদের মত পাগল ছাড়া এই ঠাণ্ডায় রাত ৯টায় কেউ হোটেল থেকে বের হয়নি। অবশ্য রাতে কাশ্মীরে করার মতো তেমন কোন টুরিস্ট এক্টিভিটিজ ও নেই।

সারাদিন জার্নির ধকল যাওয়াতে ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পরলাম। রাত ১১ টা আমার কাছে আরলিই বটে! তাছাড়া খুব ভোরে এই কনকনে শীতে সোনমারগের দিকে রওনা দিতে হবে। হোটেল মালিক গাড়ি ঠিক করে রেখেছেন।

কল্পনাও করিনি পরদিন এতবড় সারপ্রাইজ ওয়েট করছিলো। হোটেলের ছেলেটার কথাই সত্যি হলো! পরদিন ছিলো আমার জীবনের স্মরণীয় দিনগুলোর একটি। সেই কাহিনী আরেক পর্বে হবে!



পরবর্তী পর্ব মিস না করতে চাইলে ফলো বাটনে ক্লিক দিয়ে রাখতে পারেন। :)

বাংলায় আমার আরো কিছু ভ্রমণ কাহিনী

Sort:  

Hi @pitboy, your post has been upvoted by @bdcommunity courtesy of @rehan12!


Support us by voting as a Hive Witness and/or by delegating HIVE POWER.

JOIN US ON

Congratulations, your post has been added to Pinmapple! 🎉🥳🍍

Did you know every user has their own profile map?
And so does every post as well!

Want to have your post on the map too?

  • Go to Pinmapple
  • Click the get code button
  • Click on the map where your post should be (zoom in if needed)
  • Copy and paste the generated code in your post (Hive only)
  • Congrats, your post is now on the map!