ভেন্ট্রিলোকুইস্ট রিভিউ!!

in BDCommunity13 days ago

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর যাবত ভালমানের থ্রিলার লেখকের খুব অভাব বোধ করতাম। কয়েকজন হাতে গোনা থাকলেও খুব ফেমাস তেমন কাউকে পাইনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাজিমউদ্দিনকেই বেছে নিতে হতো। কিন্তু এবার বইমেলাটা আমার জন্য পুরাই ব্যতিক্রম ছিল!

আমার জানাও ছিল না বাংলাদেশে থ্রিলার জগতে এত ভাল ভাল নতুন মুখ এসেছে। আমাদের দেশি বইয়ের কমিউনিটি আর বুক রিভিউয়ারদের ঘেঁটে নতুন রাইটারদের কিছু বইয়ের লিস্ট বানালাম। একদম না জেনে কোন আইডিয়া ছাড়া অনেকটা দোনোমোনো করেই তাদের কিছু বই কিনেছিলাম।

এরই মধ্যে একটা ছিল ভেন্ট্রিলোকুইস্ট! অনেক সংশয় নিয়ে বইগুলা কিনলেও বইটার লেখক মাশুদুল হক আমাকে নিরাশ করেনি। কোন ভাল বই পড়ার পর যেই আত্মতৃপ্তি অনেকদিন পর্যন্ত থেকে যায় সেই সুখটা আয়েশ করে নিচ্ছি!

মাশুদুল হক কেমন লিখে এই নিয়ে বলতে গেলে বিশাল বড় প্যারাগ্রাফ হয়ে যাবে! ওনার লেখা পড়তে গেলে মনে হয় ধর্ম, সংখ্যাতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, মেডিকেলের খুঁটিনাটি, এমন নানা ধরণের বিষয় নিয়ে তার বেশ জানাশোনা আছে। আর বইয়ে প্রতিটা পয়েন্ট নিয়েই লেখার আগে তিনি বেশ রিসার্চ করে নিয়েছে। ভেন্ট্রিলোকুইস্টে তিনি যেই পরিমাণ তথ্য নিয়ে লেখালিখি করেছে তা প্রশংসার দাবীদার। আমি অনেকের লেখার ক্ষেত্রেই যেই সমস্যাটা দেখি তা হলো ফিকশনে যখন ইনফরমেশন দিতে যায় তখন লেখাটা বোরিং হয়ে যায় কিংবা গল্পের থ্রিল হারিয়ে যায়। কিন্তু মাশুদুলের লেখায় আমি কাহিনির চেয়ে বরং সেই ডিটেইল ইনফরমেশনগুলার জন্যই মুখিয়ে থাকতাম। তিনি গল্পের মধ্যে নিয়ে এসেছে ইতিহাস, স্থাপত্য, ধর্মতত্ত্ব, গণিতসহ আরও অনেক কিছু! এত ইনফরমেশনের মধ্যে ডুবে যাওয়ার মিক্স ফিলিংসটা পুরাই অন্যরকম!

বইটার কাহিনী একজন ভেন্ট্রিলোকুইস্টকে বেজ করে শুরু হয়। এই ব্যক্তি নাকি তার ছোটবেলার প্রেমিকার আত্মা পাপেটের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। রহস্যে ভরা এই ভেন্ট্রিলোকুইস্টের আসল কাহিনী বের করতে মাঠে নেমে পরে তারই ছোটবেলার দুই বন্ধু। আন্থোপলজির শিক্ষক মারুফ আর পত্রিকার ফিচার এডিটর রুমি মিলে খোঁজ নেয়া শুরু করে তাদের ছোটবেলার বন্ধুর ভেন্ট্রিলোকুইস্ট হওয়ার পেছনের রহস্য। কিন্তু এই একটা ছোটখাটো সন্ধান করতে গিয়ে যে ভয়ংকর এক গোপন মিশনের আস্তানায় তারা ঢুকে যাবে এটা কেউ ভাবতেও পারেনি। সেই সাথে আরও বের হয়ে আসে মানুষ নিয়ে নানা ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষার কারবার। ২০০ পাতার এই ছোট বইয়ে নানান সব তথ্য দিয়ে লেখা হয়েছে এই চমৎকার বইটি।

1713622971757.jpg

তার ডিটেইল ইনফরমেশনগুলার মধ্যে আমার সবথেকে ইন্টেরেস্টিং লেগেছে সংখ্যাতত্ত্ব আর বাহাইজম। বাহাইজমের মতন একটা ধর্ম যে পৃথিবীতে আছে এবং এটা যে বর্তমানে fastest growing religion এটা জানাই ছিল না!

তবে উনি তার লেখায় আরেকটা যেই জায়গায় সাকসেস্ফুল হয়েছে তা হলো গল্পের এক্সাইট্মেন্ট ধরে রাখা। এমনিতে অন্যান্য থ্রিলার গল্পের ধীরে সুস্থে ক্লাইমেস্কের পার্টগুলা আসে, কিন্তু তার প্রতিটা চাপ্টারই ছিল একদম টানটান উত্তেজনা। পড়তে গিয়ে দম নেয়ার মতনও সুযোগ মিলছিল না।

বইটা পড়ার সময় আমার বার বারই মনে হচ্ছিল পেশায় ডাক্তার হয়ে এত সময় আর গবেষণা করে এই বই লেখার সময় কিভাবে পেলো?! তবে সে ডাক্তার হওয়ার জন্যই হয়তো উপন্যাসে নানা ধরণের ডাক্তারি উপাদান নিয়ে আসতে পেরেছে। আর এমন সব বিষয়ের উপর ঘাঁটাঘাঁটি করা যে তার পছন্দের কাজ এটা ওনার লেখা পড়লেই বোঝা যায়।

লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বেশ ভাল মানের একটা বই। তার লেখার সাথে ড্যান ব্রাউনের প্লট সাজানোর স্টাইলের মিল পাওয়া যায়। আরেকটা যেই জিনিস ভাল লেগেছে তা হলো নাজিমউদ্দিনের কন্ট্রোলের মতন এখানে কাহিনীকে টেনেটুনে বাড়ানোর কোন ধরণের চেষ্টা করেনি। যার ফলে বইটার প্রতি আবেগ কোন খানে স্লো হয়ে যায়নি।

সবশেষে বলবো এত চমৎকার একটা মৌলিক লেখা আসলেই প্রশংসার দাবী রাখে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাংলা সাহিত্যে থ্রিলার জনরা নিয়ে একটা বড় আক্ষেপ ছিল। গুটি কয়েক মৌলিক লেখা ছাড়া সবই বিদেশী গল্পের অনুবাদ। ভৌতিক আর থ্রিলার জনরার জন্য আমাদের ওই বাংলার লেখা পড়তে হতো। সেখানে মাশুদুল হকের মতন লেখক বাংলা থ্রিলার সাহিত্যে সুন্দর মতন জায়গা করে নিতে পারবে এটাই আশা করি। কোন লেখক যখন খুব খেটে বই লেখে তখন তার জন্য আলাদা রকমের আবেগ কাজ করে। এজন্য তার বাকি বইগুলাও জোগার করে পড়ে ফেলার তালে আছি! দেখা যাক, সেগুলা কেমন হয়!