একটি স্বপ্নের অন্তিম যাত্রা

in BDCommunity4 years ago (edited)

হটাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোন পকেট থেকে বার করেই দেখি স্কিনে মা নামটা ভাষছে। ফোন রিসিভ করতেই মায়ের কন্ঠটা খুব ভারী হয়ে আসছে। ঠিকভাবে কিছু বলতে পারছিল না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে আর আতংক নিয়ে যা শুনলাম তা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

তরি ঘরি করে সোজা বাসায় রওনা দিলাম। মা'কে প্রস্তুত হতে বলে নিজেও প্রস্তুত হয়ে বার হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ড এর উদ্দেশ্যে। সোজা পার্বতীপুরের বাস উঠে পরলাম। এদিকে যেন রাস্তা শেষেই হচ্ছে না। বিপদের রাস্থা নাকি বড় হয়ে যায়। বাস থেকে নেমে ভ্যানে করে দীর্ঘ এক ঘন্টার পথ শেষে চলে আসলাম বছিবানিয়া হাট। পথিমধ্যে আবার শুরু হল বৃষ্টি ওভাবেই পলিথিন মাথায় দিয়েই সামনের দিকে আগালাম। ভ্যানে করে যাচ্ছিলাম গ্রামের রাস্তা অন্ধকার দুর থেকেই দেখা যাচ্ছে খালার বাড়িতে বাতি জ্বলছে। কিছু মানুষ দাড়িয়ে আছে কিছু মানুষ বসে আছে। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করতেছে। বাসায় ঢুকতেই কান্নার শব্দে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেছে।

পাঁচ বছরের ছোট বাবুটাকে জীবনের শেষ গোসল দিয়ে সাদা কাপড়ে পেচায় খাটিয়ার মধ্যে শুয়ে রাখছে। আর চারিদিকে পুরুষ মহিলার ভীর। আমি আর ভীর ঠেলে একটু উঁকি দিয়েই আর থাকতে পারলাম না। একটু জায়গায় এসে হাড়িয়ে গেলাম স্মৃতির পাতায়। এই তো পিচ্চি বাবুটা তার দাদা দাদীর সাথে প্রায় আসতো বাসায়। বুড়ির মত কথা বলতো। একটা চকলেট পেলেই মহা খুশি। অপেক্ষায় থাকতো কিছু আনছি কিনা। এসব ভাবতে ভাবতেই আবার হাড়িয়ে গেলাম আরেকটি স্মৃতির পাতায়। এক বছর এখনো হয়নি আমার এক মাত্র ২বছর ৭ মাসের ভাগনাকে হাঁড়িয়েছিলাম মাত্র একদিনের জ্বরে। সবার মাঝে মায়া লাগিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে ভাগনা। তার সাথে যোগ হল আরেকজন। নিশ্চয়ই জান্নাতে তারা ইব্রাহীম (আঃ) সাথে আছে। হাদিসে আছে এই বাচ্চারাই নাকি জান্নাতিদের পানি পান করাবে। স্মৃতির পাতা গুলো আর না উল্টাই।

বাচ্চার মৃত্যুর ঘটনাটি এক মুরব্বি অন্যদের খুলে বলছিল আমিও কান খারা করেই শুনছিলাম। দাদার সাথে নদীর পারে গিয়েছিল গোসল করতে। গোসল করা শেষ করে বাসায় নিয়ে আসে। পরক্ষনে আবার ছোট্ট ভাই ও বোন দুজনেই দাদাকে খুঁজতে আবার চলে যায় নদীর পারে। সেখানে খেলতে খেলতে ছোট্ট আজিজা পানিতে পরে ভেষে যায়। ছোট ভাই চিৎকার চেচামেচিতে আশে পাশের লোকজন পানিতে নামে পরে। গ্রামের সবাই একে একে নদীতে নেমে পরে। নদীর ধার বেয়ে মানুষের ভীর। মানুষের খোঁজা খুঁজিতে মাইল খানেক দুরে গিয়ে বালুর মধ্যে আটকে থাকা নিথর দেহটি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু জীবিত না মৃত উদ্ধার করে। সাথে সাথে হু হু করে কেঁদে উঠে বছিবানিয়া হাট, কেঁদে উঠে পুরো নদীর পার, কেঁদে উঠে বাচ্চা শিশু হতে শুরু করে বয়স্ক বয়সের ভারে নুয়ে পরা সকলে।

ছোট্ট মনির এই নির্মম ঘটনা লিখতে লিখতে চোখের কনে পানি জমা হয়ে যাচ্ছে। হাত ভারী হয়ে যাচ্ছে আর লিখতে পারছি না।

কালকের সকালটা প্রতিদিনের মত ভালো
কাটছিল। হাসি ঠাট্টা আর গল্প মসগুল, নাস্তা পানি আর আড্ডার উপরেই চলছিল। দিনের শেষটা এতো কষ্টদায়ক এতোবেদনাদায়ক হবে কে জানতো? কে জানত এমন দমকা হাওয়ায় কালো মেঘ নেমে আসবে নিমিষেই সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিবে😢

মহান আল্লাহ্ তায়ালা কখন কার মৃত্যু কিভাবে লিখে রেখেছে তা কেহই বলতে না পারলেও এটা নিশ্চিত সবাইকে একদিন ছেড়ে যেতে হবে। তাই আসুন ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে চিরস্থায়ী জীবনের জন্য কিছু জমা করে রাখি।

অনেক গুলো হৃদয় ভাঙ্গা গল্প আর বেদনার আঁকা অনেক গুলো শব্দ দিয়ে স্মৃতির পাতায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ নিয়ে সবাইকে বিদায় দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম মা আর আমি।

বিদায় বেলায় কোন ভাষা নেই বিদায় জানানোর চোখের অশ্রু ছাড়া। প্রিয়জনের আকস্মিক চিরতরে হাড়ানোর বেদনা সান্তনা দেওয়ার মত কোন শব্দ আল কোরআন বাদে পৃথিবীর কোন ডিকশনারিতে নেই। আর তা যদি হয় কলিজার টুকরা ছোট্ট শিশু যাকে পৃথিবীর সব গুলো জীবনের বিনিময়েও ফিরিয়ে আনা যাবে না।

তারপরেও বিদায় জানিয়ে চলে আসতে হল এক বুক ভরা কষ্ট বেদনা নিয়ে। সচ্ছ শুভ্র নিলাভ আকাশের খেলা আর নিচে সবুজের সমারোহে সব বেদনা ভূলিয়ে নিজেকে প্রকৃতিতে মধ্যে হাড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
20200807_170250.jpg

20200807_171222.jpg

অবশেষে ভ্যান, অটো, রিক্সায় দির্ঘী ক্লান্ত এই যাত্রা সমাপ্তি ঘটিয়ে বাসায়। ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে যেন ক্লান্তি আরো বহু গুনে বেড়ে গেলো। সব ক্লান্তি ঝেড়ে গোসলখানায় গিয়ে ইচ্ছা মত গোসল করলাম।

এক কাপ চা এর কাপে চুমুকে চুমুকে শেষ করেই বিছায় নিজের শরীরটাকে মেলে দিলাম। গত কাল ঘুম হয় নিই। কিভাবে বা ঘুম হবে। বাসায় কান্নার রোল। ছোট্ট কলিজার টুকরাকে নির্জন অন্ধকার কবরে একা রেখে আসে কি ঘুমানো সম্ভব?

আসলে প্রতিটা মুহূর্ত প্রতিটা ঘটনা আমাদের চরম ভাবে শিক্ষা দেয়। আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত প্রতিটা ঘটনা হতে শিক্ষা নেওয়া উচিত হলেও আমরা কিন্তু তা করি না বরং বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই। যদি প্রতিটা ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারতাম তাহলে তাহলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হয়েও যেত।