আমাদের এলাকায় মহিলারা গর্ভবতী হলে সাত মাসের সময় "সাধ" দেওয়া হয়।আমাদের অঞ্চলে হবু মায়ের জন্য আর অনাগত সন্তানের মঙ্গল কামনা করে একটা অনুষ্ঠান করা হয় যাকে সাধ বলে।একেক এলাকায় একেক রকম নিয়ম।কোন এলাকায় পাঁচ মাসে দেয়,কোন এলাকায় সাত মাসে দেয়,কোন এলাকা নয় মাসে দেয়।যেখানে যেমন হয় আরকি।আমাদের এলাকায় বাপের বাড়ি থেকে সাধ দেওয়া হয়।
আমার ছোট আপার বিয়ে হয়েছে জামালপুর।ওর বাচ্চা হবে। আজ ওর শ্বাশুড়ি ওকে সাধ দিতে এসেছে। ছোট আপার এখন বিশ সপ্তাহ চলে। ছোট আপা আমাকে যখন বলছিলো তখন এটা মনে পড়েছে। আমি যেহেতু গ্রামে বড় হয়েছি এসব অনুষ্ঠান প্রচুর দেখেছি। এর মধ্যে দুটি সাধের অনুষ্ঠানের কথা আমার বেশ মনে আছে, মানে আমার কাছে বিশেষ ছিলো তাই।
শাওন আমার থেকে প্রায় দশ বছরের ছোট তাই ওর জন্মের সময়ের সব কথায় আমার মনে আছে।যখন শাওন আম্মার পেঠে ছিলো তখন সবার স্বপ্ন ছিলো একটা ছেলের যেহেতু আমরা তিন বোন ছিলাম। আমার এখনো মনে আছে, প্রথম আমি এই কথা শুনেছিলাম আমার এক দাদীর মুখ থেকে, তিনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, "তোর মার নাকি পুলাপান হবে ছেলে হলেতো তোর আদর শেষ।" ছোট হলেও ওনার এই কথাটা আমার ভালো লাগেনি। আম্মাকে এসে বলেছিলাম আকলিমার মা এ কথা বলেছে।
আম্মা তখন বলেছিলো যে আসবে সে ভাই হোক বা বোন সে তোমার আদর ভাগ করতে আসবে না বরং তুমিও তাকে ভালবাসবে সেও তোমাকে ভালোবাসবে।তোমার আপারা যেমন সেও তেমন হবে। আমরা সবাই তার আগমনের আশায় ছিলাম তাই তার জন্মের আগের প্রতিটা দিন আমাদের কাছে বিশেষ ছিলো। আম্মার গর্ভের সময় যখন সাত মাস হলো তখন দুই মামী আম্মা সাধ নিয়ে আসলো। এর আগে অনেক সাধ দেখলেও সেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি সাধ কি।
মামী আম্মারা এগারোটার দিকে আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়।ওনারা পিঠা বাড়ি থেকে তৈরি করে নিয়ে আসছেন আর রান্নার সব কিছু নিয়ে চলে এসেছেন দুপুরের আগে রান্না করে আম্মাকে খাওয়াবেন। আমাদের দিকে সাধে পাঁচ রকমের ভাজা,পাঁচ রকমের পিঠা আর মাছ মাংস তো থাকবেই।মামী আম্মারা আস্ত মুরগী নিয়ে এসেছেন সেটা জবাই করে আস্ত ভাজী করেছেন।আলু চিকন করে কেটে ভাজি করেছেন আবার চাক চাক করে কেটেও ভাজি করছেন, বেগুনকে ফুলের মতো কেটে ভাজি করেছেন। কই মাছ আর রুই মাছ ভাজি করেছেন।আম্মা গরুর মাংস এনেছেন সেটা রান্না করেছেন। পিঠার মধ্যে এনেছিলেন ডুবা পিঠা অন্য এলাকায় যেটাকে তেলের পিঠা বলা হয়,নকশি পিঠা,বিস্কুট পিঠা চিপসজাতীয় একধরনের পিঠা,সিরিজ পিঠা,ফুল পিঠা আরও দুয়েক রকমের ছিলো।
আম্মার জন্য নতুন কাপড় আব্বার নতুন লুঙ্গিও ওনারা নিয়ে এসেছেন।আম্মাকে নতুন কাপড় পড়িয়ে একটা থালায় পোলাও ভাতের উপর আস্ত মুরগী চারপাশে ভাজি দিয়ে সাজিয়ে আরেক থালায় পিঠা সাজিয়ে আম্মাকে বসিয়ে খাইতে দিলেন। এর আগে কোনোদিন দেখেনি আম্মাকে কেউ বসিয়ে খেতে দিয়েছে শুধু দেখেছি আম্মা সবাইকে খাওয়াচ্ছে। তাই সেদিন খুব ভালো লেগেছিলো।অবশ্য আম্মা একবার মুখে দিয়ে আমাদের সবাইকে ডেকে খাইয়ে দিয়েছেন।
এরপর যখন আমি কলেজে পড়ি তখন আমার এক দাদীর সাধ দেখেছিলাম। আব্বার চাচা যিনি বয়সে আব্বার সমবয়সী।বিয়েও করেছিলেন অনেক আগে।কিন্তু বিয়ের বাইশ বছর ওনাদের বাচ্চা হয়নি।একটা মেয়ে দত্তক নিয়ে পালন করেছেন যার বয়স তখন তেরো বছর তখন ঐ দাদীর বাচ্চা হবে। সবাই খুব খুশি। ঐ দাদীকে কাজ করতে দেখেছি সবাই কে খাওয়াতে দেখেছি কোনদিন খেতে দেখেনি। হয়তো সবার খাওয়া শেষে একবার দাঁড়িয়ে কিংবা কোনায় বসে খেয়ে নিতেন।তাকে সেদিন নতুন শাড়ি পড়িয়ে বড় জামাইয়ের প্লেটে আস্ত মুরগী ভাজাসহ বিভিন্ন ধরনের ভাজা,মাংস কষা,বড় মাছেরমাথা ভুনা দশ বারো ধরনের পিঠা দিয়ে সাজিয়ে ওনাকে খেতে দিলেন। তখন থেকে আমার ধারণা গর্ভবতী হলে নারীরা রাণী হয়ে যায়।
এরপর পড়াশোনার তাগিদে ঢাকা চলে আসি তাই তেমন সাধের অনুষ্ঠান দেখা হয়নি।তবে বড় আপার বাচ্চা হবে তখন দেখেছিলাম। ছোট আপাকে সাধ দেওয়ার কথাটা শুনলাম। কিন্তু এই প্রবাসী হওয়ার কারণে অন্য সবকিছু জুটলেও রাণীর সম্মানটা পায়নি।আজ ছোট আপার সাধের কথা শুনে ভাবলাম যদি কখনও দ্বিতীয়বার মা হওয়ার সুযোগ হয় তাহলে নিজেই নিজের সাধের অনুষ্ঠান করবো।